রবীন্দ্রনাথের উদ্ভিদ তালিকা


  1. আম, আম্র (বনবাণী)
  2. আমলকী (বনবাণী)
  3. কদম, কদম্ব (বনবাণী), নীপ (বনবাণী)
  4. কাশ (বনবাণী)
  5. কুরচি (বনবাণী)
  6. খেজুর (বনবাণী)
  7. চামেলি (বনবাণী), জাঁতি
  8. ছাতিম (বনবাণী)
  9. জুঁই (বনবাণী)
  10. তাল (বনবাণী)
  11. দেওদার (বণবানী)
  12. দেবদারু (বণবানী)
  13. নাগকেশর (বনবাণী)
  14. নারকেল, নারিকেল (বনবাণী)
  15. নীলমণিলতা (বনবাণী), নীলমণি
  16. পলাশ (বনবাণী), কিংশুক (বনবাণী)
  17. মাদার, মান্দার, পারিজাত (বনবাণী)
  18. বকুল (বনবাণী)
  19. বট (বনবাণী)
  20. বনজাম (বনবাণী)
  21. বাঁশ, বেণু (বনবাণী)
  22. বেলি, বেলফুল (বনবাণী)
  23. রক্তকরবী, করবী (বনবাণী)
  24. রক্তকাঞ্চন, কাঞ্চন (বনবাণী)
  25. মধুমঞ্জরি (বনবাণী)
  26. শাল (বনবাণী)
  27. শিউলি, শেফালি (বনবাণী)
  28. শিমুল (বনবাণী)
  29. স্বর্ণচাঁপা, চাঁপা (বনবাণী)

জীবনানন্দ দাশের উদ্ভিদ তালিকা


  1. অপরাজিতা (রূপসী বাংলা)
  2. অশ্বত্থ (রূপসী বাংলা)
  3. আকন্দ (রূপসী বাংলা)
  4. আনারস (রূপসী বাংলা), আনারস ফুল (রূপসী বাংলা)
  5. আম (রূপসী বাংলা)
  6. আঁশশেওড়া, আঁশশ্যাওড়া (রূপসী বাংলা)
  7. ইউ (ঝরা পালক)
  8. এলাচ, এলাচিফুল (রূপসী বাংলা)
  9. কদম (রূপসী বাংলা)
  10. করবী (রূপসী বাংলা)
  11. করমচা (রূপসী বাংলা)
  12. কলমী (রূপসী বাংলা)
  13. কাঁঠাল (রূপসী বাংলা)
  14. কাঁঠালচাঁপা, কাঁঠালিচাঁপা (রূপসীবাংলা)
  15. কামরাঙা (রূপসী বাংলা)
  16. কাশ (রূপসী বাংলা)
  17. কুল (রূপসী বাংলা)
  18. ক্ষীরুই (রূপসী বাংলা)
  19. গোলপাতা (রূপসী বাংলা)
  20. গোলাপ (রূপসী বাংলা)
  21. ঘাস (রূপসী বাংলা)
  22. চিনিচাঁপা (রূপসী বাংলা)
  23. চাঁপা (রূপসী বাংলা), চাঁপাফুল (রূপসী বাংলা)
  24. চালতা (রূপসী বাংলা), চালতাফুল (রূপসী বাংলা)
  25. জাম (রূপসী বাংলা)
  26. জামরুল (রূপসী বাংলা)
  27. জারুল (রূপসী বাংলা)
  28. জিওল, জিউলি (রূপসী বাংলা)
  29. টগর, কাঠমল্লিকা (রূপসী বাংলা)
  30. ঢেঁকিশাক (রূপসী বাংলা)
  31. ডুমুর (রূপসী বাংলা)
  32. তমাল (রূপসী বাংলা)
  33. তাল (রূপসী বাংলা)
  34. তেঁতুল (রূপসী বাংলা)
  35. দারুচিনি (রূপসী বাংলা)
  36. ধান (রূপসী বাংলা)
  37. ধুন্দুল (রূপসী বাংলা)
  38. নলখাগড়া (রূপসী বাংলা)
  39. নাটা (রূপসী বাংলা), নাটাফল (রূপসী বাংলা)
  40. নোনা (রূপসী বাংলা), নোনাফল (রূপসী বাংলা)
  41. পদ্ম (রূপসী বাংলা)
  42. পবনঝাউ, ঝাউ (রূপসী বাংলা)
  43. পলাশ (রূপসী বাংলা)
  44. পান (রূপসী বাংলা)
  45. পামগাছ (রূপসী বাংলা)
  46. ফণীমনসা (রূপসী বাংলা)
  47. ফলসা (রূপসী বাংলা)
  48. বট (রূপসী বাংলা)
  49. বাবলা (রূপসী বাংলা)
  50. বাঁশ (রূপসী বাংলা)
  51. বাসক (রূপসী বাংলা)
  52. বুনো চালতা (রূপসী বাংলা)
  53. বেল (রূপসী বাংলা)
  54. বৈঁচি, বঁইচি (রূপসী বাংলা)
  55. ভাঁট (রূপসী বাংলা), ভাঁটফুল (রূপসী বাংলা)
  56. ভেরেণ্ডা (রূপসী বাংলা)
  57. মহুয়া (রূপসী বাংলা)
  58. মাকাল (রূপসী বাংলা)
  59. মাদার (রূপসী বাংলা)
  60. মুথাঘাস (রূপসী বাংলা)
  61. মৌরি (রূপসী বাংলা)
  62. রক্তকাঞ্চন, কাঞ্চন (রূপসী বাংলা)
  63. রক্তদ্রোণ, দ্রোণ (রূপসী বাংলা), দ্রোণফুল (রূপসী বাংলা)
  64. লিচু (রূপসী বাংলা)
  65. শটী (রূপসী বাংলা)
  66. শর (রূপসী বাংলা)
  67. শিউলি, শেফালী (রূপসী বাংলা)
  68. শিমুল (রূপসী বাংলা)
  69. শিয়ালকাঁটা, শেয়ালকাঁটা (রূপসী বাংলা)
  70. শেওড়া, শ্যাওড়া (রূপসী বাংলা)
  71. সজনে (রূপসী বাংলা), সজিনা (রূপসী বাংলা)
  72. সর্ষে (রূপসী বাংলা)
  73. সাঁচিবেত, বেত (রূপসী বাংলা)
  74. সুপারি, শুপুরি (রূপসী বাংলা)
  75. স্বর্ণলতা, আলোকলতা (রূপসী বাংলা)
  76. হিজল (রূপসী বাংলা)
  77. হেলেঞ্চা (রূপসী বাংলা)

বিরমি

হাসান মেহেদী
অলিভকুঞ্জে হা হা ক’রে হাওয়া কেঁদেছে কাতর যামিনী ভরি!
ঘাসের শাটিনে আলোর ঝালরে ‘মার্টিল’ পাতা প’ড়েছে ’ঝরি!
‘উইলো’র বন উঠেছে ফুঁপায়ে - ‘ইউ’তরুশাখা গিয়েছে ভেঙে,
তরুণীর দুধ-ধবধবে বুকে সাপিনীর দাঁত উঠেছে রেঙে!
- চাঁদিনীতে (ঝরা পালক)  

তীর দিয়ে দূরের শত্রুকে ঘায়েল করতে হলে দরকার শক্তিশালী ধনুক। শক্তিশালী ধনুক তৈরির কৌশলটি হল, এর বাতার ভেতরের দুই-তৃতীয়াংশ থাকবে সারকাঠ আর বাইরের এক-তৃতীয়াংশ হবে নমনীয় রসকাঠ। সারকাঠের দাঢ্যতায় তীরের গতি বৃদ্ধি পায়, আবার রসকাঠের নমনীয়তার কারণে খুব বেশি টানলেও ধনুকটি ভেঙে যায় না। সারকাঠের দাঢ্যতা প্রবল আবার সংলগ্ন রসকাঠ খুব নমনীয় - এমন গাছ খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। এ কারণেই শুধুমাত্র অ্যাশ, কেরিতুমড়ি, খোরসান, ভুতিবাদাম, বিরমি ও স্বর্ণমালা - এমন দুর্লভ গাছগুলো দিয়েই যুদ্ধের ধনুক তৈরি হয়। কখনও কখনও লাল ওক, কাবাসি, মিঠা ম্যাপল, চিলবিল, পেকান আখরোট গাছ দিয়েও ধনুক তৈরি হয়, কিন্তু সেগুলো হয় তুলনামূলকভাবে দুর্বল। বিলাতি মাকলুর বা লালতুঁতও ধনুকের কাঠ হিশেবে জনপ্রিয়, তবে রসকাঠ একদম ফেলে দিতে হয়, কারণ সারকাঠের দাঢ্যতা থাকলেও এদের রসকাঠ দীর্ঘস্থায়ী না। ভালো কাঠের আকালে ধনুকের ভেতরের দিকে আখরোট বা কাবাসির সারকাঠ ও বাইরের দিকে অন্য কোন নমনীয় কাঠ ব্যবহার করা হয়। 
১৬ শতকে বন্দুক উদ্ভাবনের পূর্ব পর্যন্ত একজন সৈনিকের কাছে তীর-ধনুকই ছিল সবথেকে জরুরি শস্ত্র। শক্তিশালী ধনুক যুদ্ধের গতিমুখই পাল্টে দিতে পারত। তাই অতি প্রাচীনকাল থেকেই ইউরোপীয় যোদ্ধাদের কাছে উৎকৃষ্টমানের ধনুক ছিল এক আরাধ্য বস্তু। এক্ষেত্রে বিরমির কোনো বিকল্প ছিল না। বিরমি কাঠের ছয়ফুটি ধনুকে লোহার তীর ছুঁড়ে ১০০ মিটার দূরের ধাতব বর্ম এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেলা যায়; ২০০ মিটার দূর থেকে শত্রুকে নিশ্চিতভাবে হত্যা এবং সাড়ে ৩০০ মিটার দূরের শত্রুকে গুরুতরভাবে আহত করা যায়। রোমান কবি ভার্জিল (৭০-১৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ও দার্শনিক প্লিনি (২৩-৭৯ খ্রিস্টাব্দ) তাঁদের লেখায় বিরমি কাঠের তৈরি ধনুক ও তীরের ডগায় বিরমির বিষ ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন। এর লাল সারকাঠ ও কমলা-বাদামি রসকাঠের সংমিশ্রণে তৈরি ধনুক ছিল তখনকার সৈনিকদের মর্যাদা ও শক্তির প্রতীক। স্কটল্যান্ডের ডামফ্রিজে বিরমির বাতা দিয়ে তৈরি এমন একটি ধনুক পাওয়া গেছে যা খ্রিস্টপূর্ব ৪০৪০ থেকে ৩৬৪০ অব্দের মধ্যে তৈরি করা হয়েছিল।

ইংল্যন্ডের সারে কাউন্টিতে একটি ভগ্ন দেয়াল গুড়িয়ে দিয়ে উঠে গেছে বিরমি গাছ। ছবি : Kew Science

স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ রবার্ট ব্রুস আর্চাটন মঠের চত্বরের বিরমি গাছ দিয়ে ধনুক তৈরি করেন এবং ১৩১৪ সালে সম্রাট দ্বিতীয় এডওয়ার্ডর বিরুদ্ধে ব্যানোকবার্নের যুদ্ধে ব্যবহার করেন। এ যুদ্ধে তিনি জয়লাভ করেন এবং সম্রাট যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে বাঁচেন। স্কটল্যান্ডের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয় ইংল্যন্ডও। তবে এর আগেও ইংল্যন্ডে বিরমির বাতা আমদানি হতো, তবে তা খুবই কম। ১৩৩৭ থেকে ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত শতবর্ষী লড়াইয়ের শেষদিকে এজিনকোর্টের যুদ্ধে (১৪১৫ সাল) ইংল্যন্ডের সৈন্যরা বিরমির ধনুক ব্যবহার করে প্রথমবারের মত জয়ের দেখা পায়। কামানবাহী শক্তিশালী ফরাসি বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভের পর বিরমির ধনুক তৈরির হিড়িক পড়ে যায়। ফলে কাটা পড়ে বিপুলসংখ্যক শতবর্ষী গাছ। বিরমির কাণ্ড সাধারণত বাঁকা এবং গাঁটবিশিষ্ট হয়। তাই বাছাই করা খাড়া গাছ থেকেই শুধুমাত্র ধনুক তৈরি করা সম্ভব হত। এছাড়া পৃথিবীর সবথেকে ধীরগতিতে বৃদ্ধি পাওয়া দশটি গাছের মধ্যে বিরমি একটি, যা গড়ে বছরে ৪-৬ সেমি বাড়ে। তবে ৩৬৯ বছরে মাত্র ৬৫ সেমি বৃদ্ধির উদাহরণও আছে। ভালো ধনুকের উপযোগী বাতা সংগ্রহ করতে হলে একটি বিরমি গাছের বয়স হতে হয় ৮০-১০০ বছর। 
নির্বিচার কর্তনের ফলে দ্রুতই ফর্সা হয়ে যেতে শুরু করে ইংল্যন্ডের প্রাকৃতিক বিরমি বন। পরিস্থিতি মোকাবেলায় রাজা চতুর্থ হেনরি নতুন এক ডিক্রি জারি করেন যাতে সৈন্যরা অনুমতি ছাড়াই ব্যক্তিমালিকানার বাগান থেকে বিরমি গাছ কেটে আনতে পারে। এতেও চাহিদা পূরণ না হওয়ায় ব্যাপক হারে বিরমির বাতা আমদানি শুরু হয়। আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপের ৫১টি দেশ বিরমির আবাসভূমি হলেও ভূমধ্যসাগরীয় শীতপ্রধান অঞ্চলে সবথেকে বেশি জন্মায়। সবথেকে বেশি বিরমি উৎপাদনকারী দেশগুলো হলো অস্ট্রিয়া, ইংল্যন্ড, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, ইতালি, পোল্যান্ড ও স্পেন। সুতরাং এই ৯টি দেশের মধ্য থেকেই বিরমি আমদানি করা বিধেয়।
কিন্তু ১৪২৩ সালে পোল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় ভ্লাদিস্লাভ জাগায়লা বিরমি গাছ কর্তন ও রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। অন্যান্য দেশও তাঁকে অনুসরণ করতে শুরু করে দেয়। ফলে ইংল্যন্ডে ধনুকের চরম ঘাটতি দেখা দেয়। এ সময় চার্চের পরামর্শ উপেক্ষা করে রোমান সম্রাট বিরমির বাতা রপ্তানি অব্যাহত রাখেন। কিন্তু তাতেও সঙ্কট মোকাবেলা করা যাচ্ছে না দেখে সম্রাট এক আদেশে ইংল্যন্ডের বন্দরে ভেড়া প্রত্যেক জাহাজের প্রতিটন পণ্যের জন্য চারটি বিরমির বাতা জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করেন। পরবর্তীতে সম্রাট তৃতীয় রিচার্ড প্রতিটনে চারটির জায়গায় দশটি বাতা জমা করার আদেশ দেন। ব্যাপক হারে কর্তন ও রপ্তানির ফলে ১৭ শতকের মধ্যে পুরো ব্যাভারিয়া বিরমিশূন্য হয়ে যায়। এরপর ব্রিটিশ সম্রাট বাল্টিক অঞ্চল থেকে বিরমির বাতা আমদানির চেষ্টা করেন। কিন্তু ততদিনে ব্যক্তিগত শস্ত্র হিশেবে বন্দুক জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। 
বিরমি গাছ শীতপ্রধান ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলের সব ধরনের মাটিতেই জন্মাতে পারে। তবে চুনাপাথরবহুল পাহাড়ি ভেজা মাটি ও পাতলা অরণ্যে ভালো জন্মায়। তাই ভারতের উত্তরপূর্বাংশের পাহাড়ি অঞ্চলেও বিরমি গাছ পাওয়া যায়। এমন আবহাওয়া না থাকায় বাংলাদেশে বিরমি গাছ জন্মায় না। জীবনানন্দ দাশ তাঁর রচনায় যে কয়েকটি বিদেশি উদ্ভিদের কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে ‘ইউ’ অন্যতম। জীবনানন্দ-গবেষক গোপালচন্দ্র রায় ইউ বলতে ‘সম্ভবত ইউক্যালিপটাস’ গাছ বলে ধারণা করেছেন। কিন্তু ইউ গাছের সঙ্গে ইউক্যালিপটাসের কোনো সম্পর্ক নেই। ইউক্যালিপটাস গাছটি মার্টেসি গোত্রের উদ্ভিদ, অন্যদিকে ইউ বা বিরমি গাছটি ট্যাক্সেসি গোত্রের। ব্রিটিশ উদ্ভিদবিদ জোসেফ ডালটন হুকার তাঁর হিমালয়ান জার্নালে জানাচ্ছেন, ১৮৪৮ সালে আসাম ও বঙ্গ অভিযানের সময় জুন মাসে সিকিমের কোশি নদীর অববাহিকায় তিনি বিরমি গাছের দেখতে পান। আসামের বালিপাড়া ফ্রন্টিয়ার, খাসিয়া পাহাড় (বর্তমানে মেঘালয়ের অন্তর্গত), মিশমি পাহাড় (বর্তমানে অরুণাচল প্রদেশে), মণিপুর ও হিমাচল প্রদেশে প্রাকৃতিকভাবেই বিরমি গাছ জন্মায়। হিমালয়ের পাদদেশে বিরমির পাশাপাশি জন্মায় হিমালয়ী ইউগাছও। 
জীবনানন্দ হয়তো গাছটির নাম শুনেছেন কাকা অতুলানন্দের মুখে। অতুলানন্দ দাশ ছিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও আসাম বন বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তা। থাকতেন ডিব্রুগড়ে। বছরে একবার বেড়াতে আসতেন বরিশালের পৈত্রিক ভিটায়। জাকজমকের সঙ্গে কয়েকদিন বাস করতেন আর নিজের কাজ সম্পর্কে গর্বভরে গল্প করতে পছন্দ করতেন। বনের গাছপালা সনাক্ত ও পশুপাখি শিকার করা ছিল তার নেশা। আসামের উদ্ভিদ বিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ফ্লোরা অব আসাম’-এর অন্যতম রচয়িতা তিনি। ডিব্রুগড় একদম ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে। ওপারে অরুণাচল প্রদেশ। পাশেই ডিব্রু সাইখোয়া জাতীয় উদ্যানসহ কয়েকটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। হয়তো কখনও কাকার কাছে আসামের গাছপালা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন জীবনানন্দ, যেমন ব্রজমোহন কলেজের শিক্ষক কামিনীকুমার দে’র কাছে জানতে চেয়েছিলেন নক্ষত্র সম্পর্কে। 
মানবসভ্যতার গোড়া থেকেই শিকারের হাতিয়ার ও বাদ্যযন্ত্র বানানোর কাজেও বিরমি গাছ ব্যবহারের প্রচলন চলে আসছে। ইতিহাসবিদ স্যামুয়েল ওয়ারেন ১৯১১ সালে উত্তরপূর্ব লন্ডনে অ্যাসেক্সের প্রস্তরীভূত কাদার ভিতরে প্রাকপ্রস্তর যুগের নমুনা খুঁজতে খুঁজতে একটি বিরমি কাঠের হাতিয়ার পেয়ে যান। ৩৮.৭ সেমি লম্বা এই হাতিয়ারটির কার্বন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এটির বয়স প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার বছর। এটিই মানুষের তৈরি প্রাচীনতম কাঠের হাতিয়ার। ২০০৩ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদ বার্নিস মলি ও তাঁর সঙ্গীরা আয়ারল্যান্ডের উইকলো কাউন্টির গ্রেস্টোন গ্রামের এক জলাবদ্ধ নালা থেকে ২.৮ ইঞ্চি থেকে ১১.৪ ইঞ্চি লম্বা ছয়টি বিরমি কাঠের বাঁশি উদ্ঘাটন করেন যা বড় থেকে ছোট আকারে সাজানো ছিলো। খুবই কুশলী হাতে নলাকার কাঠে ফুটো করে বাঁশিগুলো তৈরি। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের এ বাঁশিগুলো এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত কাঠের বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো। 
বিরমির বৈজ্ঞানিক নাম ট্যাক্সাস ব্যাক্কাটা। গ্রিক টক্সন থেকে উদ্ভুত হয়েছে ল্যাটিন শব্দ ট্যাক্সাস। টক্সন শব্দটির দুটি অর্থ হয় : বিষ ও ধনুক। আর ব্যাক্কাটা শব্দের অর্থ খুদিজামের মত রসালো। বৈজ্ঞানিক নামটির বাঙলা অর্থ করলে দাঁড়ায় : বিষাক্ত ও রসালো খুদিজাম-সদৃশ ফল ও ধনুক প্রদানকারী গাছ। গাছটির চরিত্র তার বৈজ্ঞানিক নামটিকে সার্থক করেছে। বীজের চারপাশের লাল রঙের শাঁসটুকু ছাড়া বিরমি গাছের শেকড়-কাণ্ড-শাখা-পাতা সবই বিষাক্ত। কোষের ভেতরে থাকা ট্যাক্সিন অ্যালকালয়েড নামক ক্ষার এই বিষক্রিয়ার জন্য দায়ী। তবে শেকড়, কাঠ, বাকল বা পাতার চেয়ে বীজ বেশি বিষাক্ত।
ওক বা ম্যাপলের মত গাছ বছরের নির্দিষ্ট সময় বিষাক্ত থাকলেও বিরমি গাছের বিষ বজায় থাকে সারাবছরই, তবে শীতকালে এর মাত্রা বৃদ্ধি পায়। পাতা শুকিয়ে ফেললে এর বিষ আরো বাড়ে। তাই শুকনো পাতার সংস্পর্শে এললেও বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা আছে। পাকস্থলি দ্রুত শুষে নেয় বলে বিরমির বিষে পশুপাখি মারা যাবার ঘটনা প্রচুর। অতিরিক্ত ট্যাক্সিন রক্তের সঙ্গে হৃদপিণ্ডে পৌঁছে এর কাজ বন্ধ করে দেয়। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মৃত্যুর জন্য ৫০-৮০ গ্রাম পাতাই যথেষ্ট। এই ট্যাক্সিন অ্যালকালয়েডের এখন পর্যন্ত কোন প্রতিষেধক আবিস্কার হয়নি বিধায় বিষক্রিয়া কমানোর জন্য অ্যাট্রোপাইন-জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। চামড়ার ভেতর দিয়েও এ বিষ প্রবেশ করতে পারে। তাই বিরমি গাছ ধরার সময় হাতে গ্লাভস পরে নেয়া উচিৎ। করাতকলে গাছ কাটার সময় নিঃশ্বাসের সঙ্গেও বিষ শরীরে প্রবেশের নজির আছে। এ কারণে ডাক্তাররা বিরমি গাছ কাটার সময় উপযুক্ত মুখোশ পরে নেয়ার পরামর্শ দেন।

বিরমির ফল ও পাতা। ছবি : Didier Descouens, Wikipedia
চমরি গাইয়ের মত কিছু প্রাণী বিরমি গাছের পাতা খেয়ে দিব্যি ঘুরেফিরে বেড়াতে পারে। এছাড়া মুনিয়াজাতীয় হ’ফিঞ্চ, সবুজ ফিঞ্চ ও তিতজাতীয় পাখিরা বিরমির বীজ খেয়ে হজম করে ফেলে। ফুল ফোটার ছয় মাস পরে বিরমির ফল পাকে। বীজ বিষাক্ত হলেও বীজের বাইরের লাল রঙের শাঁস ভক্ষণযোগ্য; রসালো ও মিষ্টি। চুটকি, দামা ও ওয়াক্সউইং-জাতীয় পাখিরা বিরমি ফলের শাঁস খায় এবং মলত্যাগের মাধ্যমে বীজের সম্প্রসারণ ঘটায়। এরপর আরো তিনমাস শুকনো ফল গাছের ডালে ঝুলে থাকে। ফলে, বংশবিস্তারের জন্য বিরমি গাছ দীর্ঘ সময় পায়। কিন্তু বিরমির অঙ্কুরোদ্গমের হার মাত্র ৩-৫ শতাংশ। প্রকৃতিতে যেসব প্রজাতির স্বাভাবিক প্রজনন সম্ভাবনা কম, তাদের প্রজননের উপায়ও বিচিত্র। গাছটির শাখা ঝুলে মাটি স্পর্শ করলে সেখান থেকে আবার শেকড় গজিয়ে নতুন গাছ জন্মায়, ঠিক যেমনটা হয় বটের ঝুরির ক্ষেত্রে। এ কারণে একে পুনর্জন্মেরও প্রতীক মনে করা হয়। এছাড়া বিরমি গাছ, যত বুড়োই হোক না কেন, গোড়া থেকে কেটে ফেললে গুঁড়ি ও তেউড় থেকে প্ররোহ বা নতুন চারা গজিয়ে ওঠে। উইলো, জিগা ও শাল গাছেও এমনটা হয়। গাছের গোড়া থেকে প্ররোহ গজায় বলেই শাল গাছের আরেক নাম গজারি।

বিরমি গাছে ফুল ফুটেছে । ছবি : Aljos Farjon, Kew Science: Plants of the World Online
বর্তমান রাইনল্যান্ড, দক্ষিণ নেদারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ ও পূর্ব বেলজিয়ামের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত রাষ্ট্র গল। তারই একটা আদিবাসীশাসিত রাজ্য এবারোন্স। খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার পাশের রাজ্য বেলজিক আক্রমণ করলে এবারোন্স আদিবাসী রাজা কাট্যুভোলকাস বেলজিকের রাজা অ্যাম্বিওরিক্সের সঙ্গে মিলে প্রতিরোধ-যুদ্ধ শুরু করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৪ অব্দে বেলজিকের পতন ঘটে। এরপর সিজার এবারোন্স দখলে অগ্রসর হন। এ যুদ্ধেও কাট্যুভোলকাস হেরে যান। রোমানদের হাতে অপমানিত হবার চেয়ে মৃত্যুই গৌরবময় ভেবে তিনি বিরমির বিষপানে আত্মহত্যা করেন। তবে জুলিয়াস সিজার বর্ণনা করেছেন যে, গ্রেপ্তার করে রোমে পাঠানো হবে এই ভয়েই কাট্যুভোলকাস আত্মহত্যা করেন। 
রোমান ইতিহাসবিদ লুসিয়াস ফ্লোরাসের রচনা অনুসারে, সম্রাট অগাস্টাসের শাসনকালে দশ বছরব্যাপী যুদ্ধের পর খ্রিস্টপূর্ব ২২ অব্দে রোমান সেনাপতি গেইয়াস ফার্নিয়াস যখন উত্তর স্পেনের ক্যান্টারবেরি অবরুদ্ধ করে স্থানীয় যোদ্ধাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান তখন তাঁদের অনেকেই আত্মসমর্পণ না করে বিরমির বিষপানে আত্মহত্যা করেন। অপর রোমান ধর্মতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ পাউলাস ওরোসিয়াস লিখেছেন যে, রোমান বাহিনী উত্তর-পশ্চিম স্পেনের অস্টারেস রাজ্যের সৈন্যদেরকে খনিশহর লাস-মেডুলাসে অবরুদ্ধ করে ফেলার পর আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে অস্টারেস বাহিনী তা অস্বীকার করে এবং বিরমির বিষপানে আত্মহত্যা করে। 
বিরমি একটি একলৈঙ্গিক বা ভিন্নবাসী উদ্ভিদ, অর্থাৎ এর একই গাছে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল জন্মানোর নজির বিরল। তবে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বিরমি গাছ লিঙ্গ পরিবর্তন করে ফেলেছে এমন প্রমাণ উদ্ভিদবিদগণ পেয়েছেন। জুন-জুলাই মাসে প্রচুর পরিমাণে পরাগরেণু পুরুষ বিরমি গাছের ফুল থেকে নিঃসরিত হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ায়। স্ত্রীগাছের পরাগধানি সেই রেণু দিয়ে নিষিক্ত হয়। গাছের অন্যান্য অংশের মত এই পরাগরেণুতেও ক্ষারীয় বিষক্রিয়া আছে। এলার্জি সংক্রমণের দিক দিয়ে পুরুষ বিরমির রেণুর মান ১০, যা উদ্ভিদ-এলার্জি স্কেল ওপালস-এর মাপকাঠি অনুসারে সর্বোচ্চ। স্ত্রী বিরমির রেণুতেও এলার্জি হয়, তবে তার মাত্রা মাত্র ১ বা সর্বনিম্ন। দেবদারু, পাইন ও সাইকাসের মত বিরমিও নগ্নবীজী উদ্ভিদ। তবে বীজটি আবৃত করে রাখে এর লাল শাঁস যা আসলে স্ফীত ডিম্বকনাড়ি। আমাদের অতি পরিচিত রসালো ফল লিচু ও জয়ত্রীর শাঁসও আসলে বীজের রসালো ত্বক নয়, স্ফীত ডিম্বকনাড়ি। 
সাধারণ একটি বিরমি গাছ ৪০০ থেকে ৬০০ বছর পর্যন্ত বাঁচে, তবে এর প্রায় দশগুণ সময়ব্যাপী জীবিত থাকার উদাহরণও আছে। ধারণা করা হয়, উত্তর ওয়েলসের ডেফিলগ গ্রামের সেন্ট সাইনগ চার্চের চত্বরের বিরমি গাছটির বয়স মোটামুটি ৫,০৬৫ বছর। কারো কারো মতে এ গাছের বয়স ২,৫০০ বছরের বেশি নয়। তবে প্রথম গণনা সঠিক ধরে নিলে সবথেকে পুরোনো মিশরীয় পিরামিড নির্মাণেরও ৫০০ বছর আগে বিরমি গাছটির জন্ম এবং মানবসভ্যতার বিবর্তনের এক অনড় সাক্ষী। শুধুমাত্র পাহাড়ি ব্রিস্টলকোন পাইন এর থেকে দীর্ঘজীবী হয়ে থাকে। বিরমি গাছের বয়স যতো বাড়ে ততোই এর মাঝখানের সারকাঠ নষ্ট হয়ে খোড়ল তৈরি হয় এবং কাণ্ড ফেটে গাছটির মাথার ভর বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ কারণেই গাছের শাখা-প্রশাখা ও পত্রাচ্ছাদন বা সামিয়ানার ওজনে কাণ্ড ভেঙে পড়ে না। উপকূলীয় রেডউড ও ব্রিস্টলকোন পাইনের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। দক্ষিণপূর্ব ইংল্যন্ডের ক্রোহার্স্টের ৪ হাজার বয়সী একটি বিরমি গাছের কাণ্ডের ঘেরের মাপ ১০ মিটার এবং আঠারো শতকে এর খোড়লের মুখে কবজাসহ একটি দরজাও লাগানো হয় যাতে গুড়ির ভেতরে সভার আয়োজন করা যায়।
ফলসহ বিরমির একটি শাখা । Aljos Farjon, Kew Science: Plants of the World Online
ইংল্যন্ড, ওয়েলস্‌, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও উত্তর ফ্রান্সের নর্ম্যান্ডি এলাকায় চার্চের চত্বরে ও কবরখানায় বিরমি গাছ লাগানো চল আছে। এজন্যেই এর আরেক নাম ‘গোরস্থানের অভিভাবক’। চার্চ ও কবরখানায় বিরমি গাছ লাগানোর এ চর্চাটি প্যাগান সংস্কৃতি থেকে এসেছে। প্যাগান বিশ্বাস অনুযায়ী, বিরমি গৌরবময় মৃত্যুর প্রতীক। গ্রীক, মিশরীয় ও রোমান সভ্যতায়ও বিরমিকে মৃত্যুর প্রতীক মনে করা হতো। এজন্যই তাদের উপাসনালয়ে ও কবরস্থানেও এ গাছ লাগানো হতো। তবে অনেকে মনে করেন, এসব স্পর্শকাতর জায়গা থেকে গবাদিপশু দূরে রাখার জন্যই এমন নিয়ম চালু হয়েছিল। বিরমির শাখা ও পাতায় বিষ থাকার কারণে গবাদিপশু এর পাশে যায় না। ষষ্ঠ শতকে পোপ প্রথম গ্রেগরি ব্রিটেনের প্যাগানদের খ্রিস্টানধর্মে দীক্ষিত করার জন্য সেন্ট অগাস্টিনকে নির্দেশ দেন। তিনি প্যাগান উপাসনালয়ের স্থানে সুন্দর নকশার গীর্জা নির্মাণেরও নির্দেশ দেন যাতে নবনির্মিত ভবনের সৌন্দর্য্যে প্যাগানরা নতুন ধর্ম গ্রহণে উৎসাহিত হয়। অন্যদিকে তাদের মনে যেন ক্ষুব্ধতা তৈরি না হয় এজন্য তিনি চত্বরের বিরমি গাছ কাটতে মানা করেন। এ কারণেই গীর্জা ও মঠের চত্বরে এখনও বিরমি গাছ দেখা যায়। অস্ট্রিয়ার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনুযায়ী বিরমি গাছ নিজ ভূমি, মানুষ, পূর্বপুরুষ ও প্রথাগত বিশ্বাসের প্রতীক। অস্ট্রিয়ায় পয়লা নভেম্বরের অল সেইন্ট দিবসে সদ্যমৃত ব্যক্তির কবরে বিরমির শাখা হাতে নিয়ে প্রার্থনা করা হয় যাতে মৃতব্যক্তি ছায়াময় শান্তিময় নিজ ভূমিতে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারেন। 
ভূমধ্যসাগরীয় অববাহিকায় অবস্থিত হওয়ায় এই ভূখণ্ডে অনিয়মিত হালকা মাত্রার বৃষ্টি হয়। ফলে সামাজিক অনুষ্ঠানে সমবেত হবার জন্য সারা বছরই আচ্ছাদনের প্রয়োজন। বিরমির বিস্তৃত ও ঘন সামিয়ানার কারণে এর তলায় অনেক মানুষ সমবেত হতে পারে। এ কারণে ইউরোপীয় পুরোনো গ্রামগুলোর মাঝখানের বারোয়ারি স্থানেও বিরমি গাছ দেখা যায়। আয়ারল্যান্ড ও উত্তর-পশ্চিম ফ্রান্সের সন্ন্যাসীরা বড় গীর্জা ও আশ্রমের চত্বরের মাঝখানে বিরমি গাছ লাগাতেন যাতে এর ছায়ায় ভবিষ্যতের শ্রমণগণ পাঠ নিতে পারেন। এরকম কয়েকটি প্রাচীন গাছের গুঁড়ির ঘের প্রায় ১৩ মিটার যার মধ্যে অনায়াসে চল্লিশজন মানুষ আশ্রয় নিতে পারে। ৫-৬ মিটার ব্যাসের একটি বিরমি গাছের সামিয়ানার ব্যাস প্রায় ৩০ মিটার যার নিচে অন্তত ১০০ জন মানুষের সমাবেশ আয়োজন করা যায়। তবে সামিয়ানার বিচারে আমাদের কাঁঠালি বট বা ঝুরিবট পৃথিবীর সবথেকে বড় উদ্ভিদ। এরপর ধারাবাহিকভাবে আছে অস্ট্রেলিয়ান ইউক্যালিপটাস, ওরিয়েন্টাল প্লেইন, মেঘশিরীষ ও শ্বেতশিমুল। তালিকার ষষ্ঠ গাছটি বিরমি। 
উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতায় ইংল্যন্ডের লরটন গ্রামের ভাঁটিখানার পেছনে নির্জন চত্বরে একাকী দাঁড়ানো বিরমি গাছের বিষাদগাথার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ ও মৃত্যুর বিরমি গাছের সংশ্লিষ্টতা উঠে এসেছে। তাঁর ‘দ্য ইউ ট্রি’ কবিতার কয়েকটি পংক্তি এমন : 
"There is a Yew-tree, pride of Lorton Vale, 
Which to this day stands single, in the midst 
Of its own darkness, as it stood of yore: 
Not loathe to furnish weapons for the Bands..." 
উইলিয়াম শেক্সপিয়র তাঁর রচনাবলিতে সাতবার বিরমি গাছের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর কাব্যে বিরমি গাছ বিষ ও মৃত্যুর পাশাপশি হয়ে উঠেছে শোকের প্রতীক। টুয়েলফ্‌থ নাইট, দ্বিতীয় রিচার্ড, টাইটাস অ্যান্ড্রেনিকাস, রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট ও ম্যাকবেথ গ্রনে' বিরমির উল্লেখ আছে। রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট কাব্যনাট্যে জুলিয়েটের পাণিপ্রার্থী কাউন্ট প্যারিস এবং রোমিও’র বিশ্বস্ত চাকর বালথ্যাজার দু’জনের মুখেই বিষের প্রতীক হিশেবে বিরমি গাছের কথা শোনা যায়। তৃতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে রোমিও’র মৃত্যুর ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে ভিক্ষু লরেন্সকে বালথ্যাজার বলছে : 
"As I did slept under this Yew tree here, 
I dreamt my master and another fought, 
And that my master slew him." 
টি.এস. এলিয়টের কাব্যে বিরমি গাছ মৃত্যু বা সমাপ্তির প্রতিচ্ছবি হিশেবে বিধৃত। তাঁর ‘ফোর কোয়ার্টার্স’ কাব্যগ্রন্থের ‘বার্ন্ট নরটন’ ও ‘লিটল গিডিং’ কবিতায় একাধিকবার এ গাছের কথা লেখা হয়েছে। লিটল গিডলিং কবিতার পঞ্চম সর্গে এলিয়ট বলছেন : 
"The moment of the rose and the moment of the yew-tree 
Are of equal duration. A people without history 
Is not redeemed from time, for history is a pattern 
Of timeless moments. So, while the light fails 
On a winter’s afternoon, in a secluded chapel 
History is now and England." 
উইলিয়াম শেক্সপিয়র, টি.এস. এলিয়ট, ওয়ার্ডসওয়ার্থ - এঁরা সকলেই ছিলেন জীবনানন্দ দাশের প্রিয় কবিদের অন্যতম। এঁদের রচনা থেকে জীবনানন্দের বিরমি গাছের ধারণা পাবার সম্ভাবনা প্রবল। প্রাচীন গৌরবময় সভ্যতার মতোই যে প্রণয় লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ তারই প্রতীক হিশেবে তিনি কি বিরমি গাছের শাখা ভেঙে যাবার কথা বলেছেন? হয়তো তাঁর মনে পড়েছিলো অস্ট্রীয় ঐতিহ্যের কথা যেখানে বিগত মানুষের স্মরণে বিরমি গাছের ডাল ভেঙে হাতে নিয়ে গ্রামবাসী যাত্রা করতো কবরখানার দিকে। তখন ভাঙা সেই ডাল হয়ে ওঠে বিগত স্মৃতির শোকগাথা। অথবা তাঁর মনে পড়েছিলো, আইরিশ লোকগাথা যেখানে পবিত্র বিরমির ডাল ভেঙে গেলে পুর্ণিমার চাঁদ সহসা অমাবশ্যার দিকে ধাবিত হয়, যা আসলে মৃত্যুরই নামান্তর!
গ্রিক পুরাণ অনুসারে বিরমি গাছ জাদুবিদ্যা, অন্ধকার ও ভেষজবিদ্যার দেবী হেকেটের সহচর। হেকেটের হাতের বিরমি গাছের স্পর্শে নরকযন্ত্রণাদগ্ধ রোগী স্বর্গীয় জীবনলাভ করতো। ফলে, ধারণা করা যায় যে, প্রাচীনকালে গ্রিসে জটিল রোগের চিকিৎসায় বিরমি গাছ ব্যবহার করা হতো। ভারতীয় উপমহাদেশেও বৈদিক যুগ থেকে ভেষজ ওষুধ হিশেবে বিরমির ব্যবহার ছিল। বিরমি গাছের পাতা থেকে পাওয়া যায় উদ্বায়ী তেল, ট্যানিক এসিড ও গ্যালিক এসিড যা আয়ুর্বেদ অনুসারে মেধাশক্তি ও রুচি বাড়ায়; জ্বর, কুষ্ঠ ও চর্মরোগ নিরাময় করে এবং দুশ্চিন্তা, জ্বালাপোড়া ও জীবাণু-সংক্রমণ দূর করে। চরকসংহিতায় চার ধরনের ওষুধ তৈরিতে এ গাছ ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। আয়র্বেদশাস্ত্রে এ গাছের নাম বরহিবরহা, শুকবরহা, শুকপুষ্প, শুকচূড়া ও কুক্কুরা। 
আধুনিক আয়ুর্বেদ অনুসারে অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, হেঁচকি, অজীর্ণ, বাতরোগ ও মৃগীরোগের চিকিৎসায় বিরমির পাতা ব্যবহার করা হয়। মুত্রথলির জ্বালাপোড়া, ব্রন, মাথাব্যথা, বাতজ্বর এবং হৃদপিণ্ড ও বৃক্ক সংক্রান্ত রোগের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় অঙ্কুর, কচি কাণ্ড ও ফলের শাঁস ব্যবহার করা হয়ে থাকে। দীর্ঘমেয়াদি ব্রঙ্কাইটিস ও ওষুধ-প্রতিরোধী ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় বিরমি ফলের শাঁস কার্যকর ওষুধ। ইউনানি-মতে মাথাঘোরা ও মাথাব্যথা, অনিয়মিত হৃদকম্পনজনিত দুর্বলতা, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসা, পানিশূন্যতা, যৌন-দুর্বলতা ও অজীর্ণ রোগের চিকিৎসায় বিরমি গাছের নবাঙ্কুরের আরক কার্যকর ওষুধ। তবে বিরমির যে কোনো ওষুধ পরিমিত মাত্রায় ও শুধুমাত্র অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে ব্যবহার করা উচিৎ। আয়ুর্বেদ অনুসারে, রোগের ধরন বিবেচনায়, দৈনিক ১-৩ গ্রাম বিরমির পাউডার সেবন নিরাপদ। অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে বিষক্রিয়ায় জীবনহানির আশঙ্কা আছে। এছাড়া গর্ভাবস্থায় এর ব্যবহারের পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে। 
পারস্যের বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক ইবনে সিনা তাঁর আল-কানুন ফি-আলতিব (চিকিৎসা বিষয়ক বিধানাবলি) গ্রন্থে ক্যালসিয়াম নির্গমনরোধের অনুঘটক হিশেবে হৃদপিণ্ডের চিকিৎসায় বিরমির নির্যাস ব্যবহারের পদ্ধতি বর্ণনা করেন। কিন্তু গত শতকের ছয়ের দশকের পূর্ব পর্যন্ত পাশ্চাত্যের চিকিৎসাবিদগণ এ ধারণা গ্রহণ করেননি। ১৯৬৭ সালে ভারতীয় বংশোদ্ভূত চিকিৎসাবিজ্ঞানী মনসুখ সি. ভাণী ও মার্কিন কেমিস্ট মনরো এলিয়ট ওয়াল যৌথভাবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় ইউ গাছের বাকলের নির্যাস থেকে প্যাক্লিট্যাক্সেল নামক রাসায়নিক আহরণ করেন, যা কর্কট রোগ নিরাময়ে কোটি কোটি যন্ত্রণাদগ্ধ মানুষের কাছে আশীর্বাদ হিশেবে আবির্ভূত হয়েছে। প্যাক্লিট্যাক্সেল বাজারে ট্যাক্সল নামে পরিচিত। কেমোথেরাপি দেয়ার সময় ধমনিতে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে এটি ব্যবহার করতে হয়। ট্যাক্সল কোষের কর্কট-সংক্রমণ বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে জানা যায় যে, বিরমি গাছে তুলনামূলকভাবে বেশি পরিমাণে ট্যাক্সল পাওয়া যায়। এরপর থেকে এই দুই ধরনের গাছের উপরই নৃশংস কুড়াল নেমে আসে। 
দুনিয়াজুড়ে প্রতি বছর ৮শ’ থেকে ১ হাজার কেজি ট্যাক্সলের চাহিদা রয়েছে যা প্রতি বছর বাড়ছে ২০ শতাংশ হারে। প্রতিকেজি ট্যাক্সলের জন্য দরকার ৩০ টন বিরমি গাছ। পর্যাপ্ত ট্যাক্সল উৎপাদনের জন্য বৈধ ও অবৈধভাবে প্রতি বছর প্রাকৃতিক বন থেকে বিরমি গাছ কেটে ২৪ থেকে ৩০ হাজার টন কাঠ, বাকল ও পাতা সংগ্রহ করা হয়, যেখানে মাত্র ৬ হাজার টন কাঠ সংগ্রহ করা নিরাপদ। কিন্তু চাহিদা ও জোগানের টানাপোড়েনে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার গোপন ও প্রকাশ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। শুধুমাত্র ভারতের দিল্লি, কলকাতা, গুয়াহাটি, ইটানগরের মত শহরে দেড়শ’রও বেশি বিরমি সংগ্রহ ও রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠান আছে। কাঠচোরেরা মেঘালয়, অরুণাচল ও মণিপুরের আদিবাসীদের সরলতার সুযোগে বন থেকে ব্যাপক হারে গাছ কেটে নিয়ে যাবার ফলে ১৯১০ সালের তুলনায় ২০১০ সালে মাত্র ৯ শতাংশ বিরমি গাছ টিকে আছে। ২০০১ সালে আসামে একটি বড় চালান আটকের পর জানা যায় যে, রাজনীতিক ও অসাধু ব্যবসায়ীদের সাথে বিরমি গাছ পাচারে বন সংরক্ষণকারী সংস্থাগুলোও যুক্ত। এমন স্বার্থজোটের কারণেই সারা পৃথিবীর বিরমি গাছ দ্রুত উজাড় হয়ে যাচ্ছে। 
১৯৯২ সালে সাবেক মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি ও নোবেল বিজয়ী পরিবেশকর্মী আল গোর কর্কটের চিকিৎসার জন্য ব্যাপকভাবে বিরমি গাছ কাটার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি লেখেন, “ধন্বন্তরী রাসায়নিক ট্যাক্সল আহরণের জন্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিরমি গাছ কাটা হচ্ছে। ফুসফুস, স্তন ও ডিম্বাশয়ের কর্কট রোগের চিকিৎসায় এ ওষুধ ব্যবহার না করলে হয়তো প্রচুর রোগীর নির্মম মৃত্যু হবে। তাই বিরমি গাছ কাটার ঘটনা আমাদের জন্য খুব স্বস্তিদায়ক। কিন্তু যখন আমরা জানি যে, প্রতিটি কর্কট-রোগীর চিকিৎসায় তিনটি করে পূর্ণবয়স্ক গাছ কেটে ফেলা হয়, তখন ঘটনা আর স্বস্তিদায়ক থাকে না”। এর পরপরই বিশ্বব্যাপী বিরমি গাছ কাটার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুরু হয়। আন্দোলনকারীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেপাল, ভারত, ভুটান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বহু দেশে বিরমি গাছ সংরক্ষিত উদ্ভিদের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে এবং অনুমতি ছাড়া গাছ কাটলে কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডের বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। 
এরই মধ্যে ১৯৮৬ সালে ইউরোপীয় ইউগাছের পাতার নির্যাসের সঙ্গে কৃত্রিম রাসায়নিক মিশিয়ে তৈরি করা হয় আধাকৃত্রিম ডোসিট্যাক্সেল। ১৯৯৫ সাল থেকে এটি পাকস্থলি, স্তন, মাথা-ঘাড়, প্রোস্টেট ও ফুসফুসের কর্কট রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ইদানিং ভুতিবাদাম ও হ্যাজলনাটের বাকল থেকেও ডোসিটাক্সেল তৈরি হচ্ছে। কিন্তু ট্যাক্সলের তুলনায় ডোসিট্যাক্সেলের দাম খুব বেশি। উন্নয়নশীল দেশের বাজারে ১০০ মিগ্রা ট্যাক্সলের দাম ৬শ’ থেকে ১১শ’ ৫০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। অপরদিকে ডোসিট্যাক্সেলের ৮০ মিগ্রা একটি অ্যাম্পুলের দাম ১৩শ’ ৫০ থেকে ৭ হাজার ৪৫০ টাকা পর্যন্ত উঠতে পারে। দামের এই পার্থক্যের কারণে ট্যাক্সল এখনও খুবই জনপ্রিয়। 
ট্যাক্সলের ব্যাপক চাহিদার কারণেই বিরমি চাষ একটি লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে। মেঘালয় ও অরুণাচল সরকারের উদ্যোগে ব্যক্তিপর্যায়ে বিরমি গাছের চাষ শুরু হয়েছে। ভারতীয় বন গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বন বিভাগের যৌথ উদ্যোগে বিরমির পুনর্বনায়নও হচ্ছে। সম্প্রতি জম্মু ও কাশ্মীরের শীতপ্রধান এলাকায় বিরমি চাষের চেষ্টা করা হচ্ছে। বিরমির শাখার সরাসরি কাটিং পদ্ধতি সম্প্রসারণে সহায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে ২০১৭ সালে আইইউসিএন রেড লিস্টে ইউগাছকে ‘সংশয়হীন’ তালিকায় রেখেছে।
কিন্তু ভাল মানের ট্যাক্সল সংগ্রহ করতে হলে বিরমি গাছের বয়স কমপক্ষে ২০ বছর হতে হয়। ব্যক্তিগত জমি এত বছর ধরে উৎপাদনহীন রাখার মত কৃষক উপমহাদেশে বিরল। এ কারণে যেসব বনাঞ্চল দুর্গম ও নজরদারির ব্যবস্থা দুর্বল, সেখান থেকে বিরমি গাছ দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৬ সালে প্রাকৃতিক বন থেকে বিরমি গাছ সংগ্রহ, বাজারজাতকরণ ও রপ্তানি নিষিদ্ধ করে দেয়। বিরমি গাছের উপযোগী শীতপ্রধান এলাকাগুলোতে ব্যাপক হারে পুনর্বনায়ন এবং নিজাবাস ও বহিরাবাস সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করলে এই মূল্যবান উদ্ভিদটি পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যাবে। 

বিরমি 

বাঙলা নাম : বিরমি, ভিরমি, সুগন্ধা, তালিশপত্র, ইউ
বৈজ্ঞানিক নাম : Taxus baccata L.
প্রচলিত সমনাম : Cephalotaxus adpressa Beissn.
ইংরেজি নাম : Yew, Common Yew, European Yew, English Yew
অন্যান্য নাম : গ্রন্থিপর্ণ (সংস্কৃত), মাণ্ডুপর্ণী (সংস্কৃত), তালিসপত্র (সংস্কৃত), শুকপুষ্প (আয়ুর্বেদ), শুকচূড়া (আয়ুর্বেদ), গাল্লু (হিন্দি), থুনো (হিন্দি), তেসিয়াং (অরুণাচল), বার্মাপাল্লা (নেপালি), থালিশপত্র (নেপালি), বার্মি (মারাঠি), স্থৌনেয়াক (কান্নাড়া), বিরমি (পাঞ্জাবি), ঠোনা (পাঞ্জাবি), জর্নব (উর্দু), সর্খদার (ফার্সি), তালিসমার (আরবি), জু-শান (চিনা)
মাঝারি বা ছোট বৃক্ষ, চিরসবুজ। উচ্চতা ১০-২০ মিটার, সর্বোচ্চ ২৮ মিটার; বাকল লালচে ধূসর বা লালচে বাদামি। পাতার রঙ উপরে গাঢ় সবুজ, তলার দিকে হলদে সবুজ। পাতা দ্বিপক্ষল, রেখাকার ও সরু; লম্বায় ১-৪ সেমি ও চওড়া ২-৩ মিমি। পুরুষ ফুল বর্তুলাকার, রঙ হলুদ; স্ত্রী ফুল খাড়া ও সবুজ, পাতার গোড়া থেকে জন্মায়। ফুল ফোটার সময় বসন্তকাল, মার্চ - জুলাই। ফল (বীজের আবরণ) ডিম্বাকার; ৮-১৫ মিমি লম্বা, নিচের দিকে খোলা; কাঁচা অবস্থায় সবুজ ও পাকলে লাল।
বিস্তৃতি : অস্ট্রিয়া, আজারবাইজান, আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আলজেরিয়া, আলবেনিয়া, আয়ারল্যান্ড, ইউক্রেন, ইতালি, ইরান, এস্তোনিয়া, গ্রিস, চিন, চেক রিপাবলিক, জর্জিয়া, জাপান, জার্মানি, জিব্রালটর, ডেনমার্ক, তুরস্ক, নরওয়ে, নেদারল্যান্ড, পর্তুগাল, পাকিস্তান, পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, বার্মা (মিয়ানমার), বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, ভারত, ভুটান, মন্টেনেগ্রো, মরক্কো, মালদোভা, মাল্টা, মোনাকো, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, রোমানিয়া, লাটভিয়া, লিচটেন্সটেইন, লুক্সেমবার্গ, সার্বিয়া, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, স্পেন, স্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরি

সংশ্লিষ্ট উদ্ভিদ

  1. অস্ট্রেলীয় ইউক্যালিপ্টাস : Eucalyptus microtheca F.Muell.
  2. উপকূলীয় রেডউড : Sequoia sempervirens (D.Don) Endl.
  3. ওরিয়েন্টাল প্লেইন : Platanus orientalis L.
  4. কাবাসি : Acer campbellii Hook.f. & Thomson ex Hiern
  5. কেরিতুমড়ি : Pittosporum kerrii W.G. Craib 
  6. খোরসান : Pittosporum napaulense (DC.) Rehder & E.H. Wilson 
  7. চিলবিল : Holoptelea integrifolia Planch. 
  8. জিগা : Lannea coromandelica (Houtt.) Merr. 
  9. পেকান আখরোট : Carya illinoinensis (Wangenh.) K.Koch 
  10. প্রশান্ত মহাসাগরীয় ইউ : Taxus brevifolia Nutt. 
  11. বট বা কাঁঠালি বট : Ficus benghalensis
  12. বিলাতি মাকলুর : Maclura pomifera (Raf.) Schneid.
  13. ব্রিস্টলকোন পাইন : Pinus longaeva D.K.Bailey 
  14. ভুতিবাদাম : Corylus jacquemontii Decne. 
  15. মিঠা ম্যাপল : Acer saccharum Marshall 
  16. মেঘশিরীষ : Samanea saman (Jacq.) Merr. 
  17. লাল ওক : Quercus rubra L. 
  18. লালতুঁত : Morus rubra L. 
  19. শ্বেতশিমুল : Ceiba pentandra (L.) Gaertn. 
  20. স্বর্ণমালা : Laburnum anagyroides Medik. 
  21. হ্যাজলনাট : Corylus avellana L.
  22. হিমালয়ী অ্যাশ : Fraxinus floribunda Wall. 
  23. হিমালীয় ইউ : Taxus wallichiana Zucc. 
  24. হেমলক : Conium maculatum L.

সংশ্লিষ্ট প্রাণী

  1. ওয়াক্সউইং : Bombycilla গণভূক্ত পাখি
  2. চুটকি : Muscicapidae গোত্রভূক্ত পাখি
  3. তিত (বড়) : Parus major Linnaeus 
  4. দামা : Turdidae গোত্রভূক্ত পাখি 
  5. মুনিয়া : Lonchura গণভূক্ত পাখি 
  6. সবুজ ফিঞ্চ : Chloris chloris Linnaeus
  7. হ’ফিঞ্চ : Coccothraustes coccothraustes Linnaeus
 

সহায়ক শব্দাবলি 

  1. আরক : Tincture 
  2. উপক্রান্তীয় : Sub-tropical 
  3. ওপালস : Ogren Plant Allergy Scale (OPALS) 
  4. তেউড়ি ও ধাবকমূল : Sucker 
  5. নিজাঙ্গন, নিজাবাস : In-situ 
  6. প্ররোহ বা গজ : Coppice 
  7. বর্তুলাকার : Globose 
  8. বহিরাবাস : Ex-situ 
  9. ভিন্নবাসী : Dioecious 
  10. রসকাঠ : Sapwood 
  11. রেখাকার : Linear 
  12. সামিয়ানা বা পত্রাচ্ছাদন : Canopy 
  13. সারকাঠ : Heartwood
  14. স্ফীত ডিম্বকনাড়ি : Aril 
 

তথ্যসূত্র

  1. Alloatti, G.; Penna, C.; Levi, R.C.; Gallo, M.P.; Appendino, G.; Fenoglio, I. (1996). "Effects of yew alkaloids and related compounds on guinea-pig isolated perfused heart and papillary muscle". Life Sciences. 58 (10): pp 845-854
  2. আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হক, ইনাম আল; কবির, সৈয়দ মোহাম্মদ হুমায়ুন; আহমাদ, মোনাওয়ার; আহমদ, আবু তৈয়ব আবু; হাসান, মো. আবুল; বেগম, জেডএন তাহমিনা ও খন্দকার, মনিরুজ্জামান. ২০০৯ঙ. বাংলাদেশের উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ. ২৬তম খণ্ড. বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা : আগস্ট ২০০৯. পৃ ৩৫৩ 
  3. Kanjilal, U.N., Kanjilal, P.C., De, R.N. & Das, A. (1940). Flora of Assam (Vol. IV: Nyctaginaceae to Cycadaceae). Forest Department of Assam and Prabasi Press, Calcutta: February 1940. p 346 
  4. Quattrocchi, Umberto. 2012. CRC World Dictionary of Medicinal and Poisonous Plants: CRC Press, Boca Raton: May 2012. p 3679 
  5. Khare, C.P. 2007. Indian Medicinal Plants: An Illustrated Dictionary. Springer Science & Business Media, New Delhi: December 2007. p 648 
  6. Ginsberg, Judah. 2003. The Discovery of Camptothecin and Taxol: Celebrating Chemistry. American Chemical Society, Washington DC: 23 April 2003. p 3 
  7. Gore, Albert Arnold. 1992. Earth in the Balance: Ecology and the Human Spirit (Third Edition: October 2006). Rodale Books, New York: December 1992. p 119 
  8. গুহ, অরবিন্দ. ২০১৫. “জীবনানন্দ এবং আরও কয়েকজন”. . উদ্ধৃত, বিমূঢ় বিস্ময় : জীবনানন্দ দাশ. সম্পাদনা : রকিবুল হাসান, তাহা ইয়াসিন ও শামস্‌ আল্‌দীন. সমাচার, ঢাকা : ফেব্রুয়ারি ২০১৫. পৃ ৭৬ 
  9. গুহ, ভূমেন্দ্র (সম্পা.). ২০১৭. কুসুমকুমারী দাশের দিনলিপি. আদম, কৃষ্ণনগর : জানুয়ারি ২০১৭. পৃ ৯৮ 
  10. Thomas P.A. & Polwart, A. 2003. Taxus baccata L. in Biological Flora of British Isles. Journal of Ecology, Vol. 91, Issue 3: June 2003. p 499 
  11. দাশ, কুসুমকুমারী. ২০১২ক. দৈনন্দিন লিপি (সম্পাদনা : ভূমেন্দ্র গুহ). অবসর প্রকাশনা সংস'া, ঢাকা : ফেব্রুয়ারি ২০১২. পৃ. ১১৫ 
  12. দাশ, জীবনানন্দ. ১৯৯৯ক. জীবনানন্দ দাশ রচনাবলী. প্রথম খণ্ড : কবিতা. (সম্পা. দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়). গতিধারা, ঢাকা : ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯. পৃ ৪৪ 
  13. দে, সুবিমলচন্দ্র. ২০১২. উদ্ভিদ পরিচয়. আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা : আগস্ট ২০১২. পৃ ২১৩ 
  14. দে, সুবিমলচন্দ্র. ২০১৭. উদ্যান-প্রযুক্তি অভিধান. আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা : জানুয়ারি ২০১৭ 
  15. Dhyani, Srishti; Sharma. A.K. & Deep, Kour Gagan. 2014. Taxus Baccata Linn.: A Mystical Herb. Unique Journal of Pharmaceutical and Biological Sciences (UJPBS). ISSN 2347-3614, 02 (02): March-April 2014. p 68 
  16. Polunin, Oleg & Stainton, Adam. 1997. Flowers of the Himalaya (12th Impression: 2018). Oxford India, New Delhi:  May 1997. p 391 
  17. ফরিদ, জায়েদ. ২০১৬. উদ্ভিদস্বভাব : গাছপালার বিচিত্র জীবনকথন. ১ম খণ্ড (দ্বিতীয় মুদ্রণ : জুলাই ২০১৭). কথাপ্রকাশ, ঢাকা : ফেব্রুয়ারি ২০১৬. পৃ ১৫০ 
  18. Bevan-Jones, Robert. 2004. The Ancient Yew: A History of Taxus Baccata. Windgather Press, London: 2004. p 46 
  19. Rawat, J.S.; Nimasow, Gibji; Nimasow, Oyidai; Norbu, Leki & Loder, Tasso. 2011. Cancer of Illegal trade threatens the Anti-cancer Yews. Journal of Science & Culture, Vol. 77, Issue 1-2: April 2011. p 46 
  20. রায়, গোপালচন্দ্র. ২০১২. জীবনানন্দ (তৃতীয় সংস্করণ). পারুল প্রকাশনী, কলকাতা : ২০১২. পৃ ১৬৬ 
  21. Lanker, Ubeed; Malik, A.R.; Gupta, N.K. & Butola, Jitendra S. 2020. "Natural Regeneration Status of the Endangered Medicinal Plant, Taxus baccata Hook. F. syn. T. wallichiana, in Northwest Himalaya". International Journal of Biodiversity Science, Ecosystem Services & Management. Vol. 6, Issue 1-2: November 2020. p 20 
  22. শর্মা, দ্বিজেন. ২০০৪. হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ড্যালটন হুকার. সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা : ফেব্রুয়ারি ২০০৪. পৃ ৩২
  23. Sharma, Prabha; Uniyal, Prem Lal & Slwik, Jolanta. 2014. "Community Involvement and Conservation of Taxus baccata in Pangi Valley, Himachal Pradesh". Natural Areas Journal, 34(4), 470-474: October 2014. p 472
  24. Caesar, Julius. 2012. The Gallic Wars (Commentarii de Bello Gallico, 58-49 BC). W.A. Macdevitt (Trans.). Vol. 6. Bottom of the Hill Publishing, Somerville: February 2012. p 32
  25. Harrison, Christina & Kirkham, Tony. 2019. Remarkable Trees. Thames & Hudson Limited and Royal Botanic Gardens Kew, London: October 2019. p 58
  26. Hobbs, K. & West, D. 2020. The Story of Trees and how they changed the Way We Live. Laurence King Publishing Ltd., London: February 2020. p 15
  27. Hooker, Joseph Dalton. 1854b. Hilayan Journals or Notes of a Naturalist in Bengal, the Sikkim and Nepal Himalyas, the Khasia Mountains & C. Vol. II. John Murray Company, London: January 1854. p 45

কৃতজ্ঞতা

  1. গৌতম মিত্র, জীবনানন্দ-গবেষক, কলকাতা
  2. মো. মিজানুর রহমান, নিসর্গী, ঢাকা
  3. সুশান্ত সরকার, সাহিত্যিক ও ভাষাবিদ, খুলনা

Taxus (L.)

  1. Taxus baccata L.
  2. Taxus wallichiana Zucc.

Taxaceae (S.F.Gray)

  1. Taxus L.

Nymphoides (Ség.)

Nymphoides গণটি Menyanthaceae বা চাঁদমালা গোত্রের অন্তর্ভূক্ত। ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ, অক্ষরবিদ, জ্যোতির্বিদ ও উদ্ভিদবিদ জ্যঁ ফ্রাঙ্কো সেগুয়ের (Jean-François Séguier) ১৭৫৪ সালে Nymphoides গণের নামকরণ করেন। Menyanthaceae গোত্রের ৮টি গণ থাকলেও শুধুমাত্র Nymphoides গণের উদ্ভিদ বাঙলাদেশে পাওয়া যায়। 
জ্যঁ ফ্রাঙ্কো সেগুয়ের ১৭০৩ সালের ২৫ নভেম্বর জন্মগ্রহণ এবং ১৭৮৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। দক্ষিণ ফ্রান্সের মন্টপেলার শহরে তিনি আইন বিষয়ে পড়াশোনা করার সময়ই তিনি উদ্ভিদবিদ্যার প্রেমে পড়ে যান। বন্ধু, ইতালীয় লেখক ও নাট্যকার এবং সহকর্মী স্কিপিও মাফেই ও সেগুয়ের ১৭৩২ থেকে ১৭৩৬ পর্যন্ত চার বছর ধরে পুরো ইউরোপের এমাথা ওমাথা চষে বেড়ান শুধু উদ্ভিদ বিষয়ক বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ করার জন্য। ১৭৫৫ সালে তিনি আকাদেমি দ্য নিমে (Académie de Nîmes)-এর সদস্য মনোনীত হন এবং ১৭৬৫-১৭৮৪ সাল পর্যন্ত নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৭৭২ সালে তিনি ফরাসি মানবিক বিজ্ঞান একাডেমি’র (Académie des Inscriptions et Belles-Lettres) সদস্য নির্বাচিত হন। ১৭৪৫-৫৪ সাল পর্যন্ত নয় বছর ধরে তিনি তিন খণ্ডের Plantae Veronenses নামে ইতালির ভেরোনা অঞ্চলের উদ্ভিদের পরিচিতি বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এছাড়া ১৭৪০ সালে Bibliotheca botanica নামে ইউরোপীয় ঔষধি উদ্ভিদের একটি তালিকাও প্রকাশ করেন। এছাড়া তাঁর আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা আছে। 
তাঁর সম্মানে Seguieria গণটির নামকরণ করা হয়। Seguieria গণের কোনো উদ্ভিদ বাঙলায় পাওয়া যায় না। দক্ষিণ আমেরিকায় পাওয়া যায় Seguieria macrophylla যার ইংরেজি নাম Red Inkplant বা লালকালি। এছাড়া Ranunculus গণের Ranunculus seguieri (জলধনিয়া’র একটি প্রজাতি, বাঙলায় নেই) এবং Euphorbia seguieriana (দুধিয়া’র একটি প্রজাতি, বাঙলায় নেই)-এর প্রজাতির নাম দেয়া হয়েছে তাঁর নামে। 
ল্যাটিন Nymph ও Oides শব্দ যুক্ত হয়ে Nymphoides শব্দটা তৈরি হয়েছে। এর অর্থ নিম্ফের মতো। গ্রীক ও রোমান পুরাণ অনুসারে সমুদ্র, বন ও পর্বতসংলগ্ন জলধারায় অধিষ্ঠানকারী কুমারী উপদেবী বা পরীদের নিম্ফ বলা হয়। প্রকৃতিকে জীবন্ত করে দেয়ার দায়িত্ব নিম্ফদের এবং তারা গাইতে ও নাচতে পছন্দ করে। জলের উপর যারা প্রকৃতই দুলে দুলে নাচে তারা Nymphaea গণের অন্তর্ভূক্ত। এ নাম দিয়েছেন কার্ল ভন লিনিয়াস। যেমন শাপলা। কিন্তু যারা পুরোপুরি Nymphaea না, কিন্তু নিমফিয়ার মতো, তারা হলো Nymphoides। চাঁদমালা ও তার ভাইবোনেরা তাই নিম্ফোইডেস। 
Nymphoides এক প্রকার জলজ উদ্ভিদ যা সাধারণত বহুবর্ষজীবী। জলের উপর ভাসমান বা শয়ান অবস্থায় থাকে। মাটিতে শেকড় গাড়ে না বরং এক জায়গা থেকে ভেসে অন্য জায়গায় চলে যেতে পারে। এ উদ্ভিদের লম্বা, ভাসমান গোলাকার কাণ্ড থাকে যার গিঁট থেকে মূল বা উপমূল (rootlet) গজাতে পারে। অধিকাংশ সময় পরিবর্ত পত্র (alternate), কদাচিৎ বিপরীত পত্র (opposite) হয়। ভাসমান পত্রফলকে হাতের তালুর মতো কেন্দ্র থেকে চারদিকে ছড়ানো পত্রশিরা থাকে। অখণ্ড পাতা হৃৎপিণ্ডাকার, উপবৃত্তাকার বা গোলাকার। মঞ্জরীদণ্ডের পর্বের উপর গুচ্ছবদ্ধ ফুল সাদা অথবা হলুদ রঙের হয়। চারটি বা পাঁচটি বৃত্যাংশের প্রত্যেকটির মাঝখান থেকে কিছুটা নিচে অনুদৈর্ঘ্য ভাঁজ বর্তমান। চারটি বা পাঁচটি পাপড়িলগ্ন পুংকেশর। এক প্রকোষ্ঠের গর্ভাশয় যার গর্ভমুণ্ড দ্বিখণ্ডিত। চোঙ্গাকৃতি (cylindrical) ফল অর্ধ অবিদারি (indehiscent)। অর্থাৎ বীজ পরিপক্ক হলেও বীজাধার ফেটে যায় না। বীজাধার (capsules) উপবৃত্তাকার, ডিম্বাকার বা গোল। একসঙ্গে অনেকগুলো চাকতি আকৃতির বীজ হয়। কোনো কোনো বীজের পাখনা আছে। 
কিউ বোটানিক্যাল গার্ডেন ও দ্য প্লান্ট লিস্ট অনুসারে নিম্ফোইডেস গণ-এর মোট ৬১টি উদ্ভিদ আছে যার মধ্যে ৩৪টি গৃহীত (accepted) ও ২৭টি অমীমাংসিত (unresolved)। 
৬১টি প্রজাতির মধ্যে বৃহত্তর বাঙলায় (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) চারটি প্রজাতি পাওয়া যায়। প্রজাতিগুলো হলো : 
  1. Nymphoides aurantiaca (Dalzell) Kuntze
  2. Nymphoides hydrophylla (Lour.) Kuntze
  3. Nymphoides indica (L.) Kuntze ও
  4. Nymphoides parvifolia Kuntze (গৃহীত নাম : Limnanthemum parvifolium Griseb.)

Nymphoides গণ-এর প্রজাতিসমূহ শনাক্তকরণ চিহ্ন : 

১. কাণ্ডে (stem) কোনো শাখা নেই। কাণ্ডের মূল অংশে (stem node) পরিবর্ত পত্র (alternate), অগ্রভাগে (stem apex) বিপরীত পত্র (opposite); ২.৫-৩.০ সেমি লম্বা পাপড়ি বা পুষ্পদল সোনালি হলদে রঙের। বীজাধার ১.৭-২.৫ সেমি লম্বা। চ্যাপ্টা বীজ ৪-৫ মিমি। বীজ ঘন সন্নিবেশিত : Nymphoides peltata (S.G.Gmel.) Kuntze 
২. কাণ্ডে (stem) শাখা আছে। কাণ্ডের মূল অংশে ১-৩টি পাতা; অগ্রভাগে একক পত্র (solitary) : 
২.১ বৃত্যাংশ ৪-৫টি; বীজাধার আয়ত-উপবৃত্তাকার, ২.৫-৫.০ মিমি পুরু; প্রান্ত সামান্য কীলকাকার; বীজ ০.৩-০.৫ মিমি; প্রত্যেক গর্ভ-প্রকোষ্ঠে দুইয়ের বেশি সারিতে বীজ থাকে; মসৃণ বীজাধারের গায়ে কোনো দাগ নেই : Ludwigia perennis L. 
২.২ বৃত্যাংশ ৪টি; বীজাধার সরু বেলনাকার, ১-২ মিমি পুরু ও কিছুটা চতুষ্কোণ; বীজের আকার ০.৫-০.৬ মিমি, প্রতি গর্ভ-প্রকোষ্ঠে ১ সারিতে বিন্যস্ত; বীজাধারের গায়ে স্পষ্ট দাগ আছে : Ludwigia prostrata Roxb.

Ludwigia octovalvis (Jacq.) P.H. Raven

লাল বনলঙ্গা

বৈজ্ঞানিক নাম : Ludwigia octovalvis (Jacq.) P.H. Raven 
সমনাম : Epilobium fruticosum Lour.; Jussiaea octovalvis (Jacq.) Sw.; Jussiaea pubescens L.; Jussiaea suffruticosa L.; Ludwigia angustifolia (Lam.) M. Gómez; Ludwigia pubescens (L.) H. Hara; Ludwigia suffruticosa (L.) M.Gómez; Oenothera octovalvis Jacq. 
বাঙলা নাম : লাল বনলঙ্গা, লাল বনলবঙ্গ, ভুঁইকুমড়া 
ইংরেজি নাম : Mexican Primrose-Willow, Mexican Seedbox, Willow Primrose, Shrubby Ludwigia 
অন্যান্য নাম : বন ঝলকিয়া (আসাম), লুডভিগিয়ে আ ফ্লেয়্যুর সিসিলিস (ফরাসি), কাট্টুগ্রাম্ব (মালায়লাম), বনলং (হিন্দি), কাউকাকুলা (কানাড়া); পান লবঙ্গ (মারাঠি), ভূ লবঙ্গ (সংস্কৃত), কাট্টু কিরাম্পু (তামিল), নীরুবাক্কল (তেলেগু)

Ludwigia hyssopifolia (G.Don) Exell

ভুঁইশাক


বৈজ্ঞানিক নাম : Ludwigia hyssopifolia (G.Don) Exell
সমনাম : Fissendocarpa linifolia (Vahl) Bennet; Jussiaea fissendocarpa Haines; Jussiaea hyssopifolia G.Don; Jussiaea linifolia Vahl; Jussiaea weddellii Micheli; Ludwigia linifolia (Vahl) R.S.Rao 
বাঙলা নাম : পানিলঙ, ভুঁইশাক, গাঙচুমু 
ইংরেজি নাম : Seed-box, Hyssop-leaved Water Primrose 
অন্যান্য নাম : নীর গ্রাম্পু (মালয়ালাম), বাসলাসিরা (মালয়ালাম) 
ব্রিটিশ শ্রেণীকরণবিদ, উদ্ভিদবিদ ও সাংকেতিক ভাষা-বিশারদ আর্থার ওয়ালিস এক্সেল (Arthur Wallis Exell) লুডভিগিয়া হিসপিফোলিয়া নামকরণ করেন। আর্থার এক্সেল ১৯০১ সালের ২১ মে ইংল্যন্ডের বার্মিংহামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২৬ সালে স্নাতকোত্তর পাস করার আগেই ১৯২৪ সালে তিনি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে দ্বিতীয় শ্রেণীর সহকারি হিশেবে যোগ দেন। আফ্রিকার উদ্ভিদপ্রজাতি সম্পর্কে জানার জন্য ১৯৩২ সালে তিনি গিনি উপসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোতে ১ বছর অভিযান চালান এবং ১৯৪৪ সালে Catalogue of the Vascular Plants of Saint Tome নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। 
এরই মধ্যে পর্তুগীজ উদ্ভিদবিদ লুইস ক্যারিসো ও ফ্রান্সিসকো মেন্ডোঙ্কার সঙ্গে এক্সেলের বন্ধুত্ব হয়। তাঁদের সহযোগিতায় তিনি ১৯৩৭ সালে অ্যাঙ্গোলার উদ্ভিদ বিষয়ক গ্রন্থ Conspectus Florae Angolensis প্রকাশ করতে সমর্থ হন। পর্তুগীজ, জার্মান, ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার এক্সেলকে যুদ্ধকালীন যোগাযোগ দপ্তরে নিয়োগ করে। এ সময় তিনি সাংকেতিক ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। 
১৯৫০ সালে তিনি ব্রিটিশ মিউজিয়ামের উপসংরক্ষক পদে নিযুক্ত হন। এরপর তিনি মোজাম্বিকের উদ্ভিদপ্রজাতি বিষয়ে কাজের সুবাদে বহুবার মোজাম্বিক ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় সফর করেন। তারই ফলস্বরূপ ১৯৬২ সালে তাঁর Flora Zambesiaca নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ওই বছরই পর্তুগালের কোইমব্রা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.এসসি (ডক্টর অব সায়েন্স) ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৬২ সালেই মিউজিয়ামের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এক্সেল কিউ গার্ডেনে খণ্ডকালীন উদ্ভিদবিদ হিশেবে কাজ শুরু করেন। 
আর্থার ওয়ালিস এক্সেল ইংল্যান্ডের চেলথেনহ্যামে ১৯৯৩ সালের ১৫ জানুয়ারি মারা যান। তাঁর শনাক্তকৃত উদ্ভিদসমূহের বৈজ্ঞানিক নামের শেষে Exell শব্দটি ব্যবহার করা হয়। তাঁর সম্মানে আফ্রিকার একটি মাছের গণের নাম Exellia ও গোত্রের নাম Exelliidae দেয়া হয়েছে। এছাড়া অনেকগুলো উদ্ভিদের প্রজাতির নাম exellii দেয়া হয়েছে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। 
স্কটল্যান্ডের উদ্ভিদবিদ জর্জ ডন (George Don) ১৮৩২ সালে উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক নাম দিয়েছিলেন জাসিইয়া হিসপিফোলিয়া। ফরাসি প্রকৃতিবিদ ও উদ্ভিদবিদ বার্নার্ড ডি জাসিই থেকে জাসিইয়া এবং Hyssopifolia মিলে এমন নামকরণ। Hyssop অর্থ জুফা বা ইসপ (Hyssopus officinalis) এবং Folia অর্থ পাতা। অর্থাৎ জুফা গাছের পাতার মতো যে গাছের পাতা তাঁর নাম হিসপিফোলিয়া। ডনের সূত্র অনুসরণ করে আর্থার এক্সেল উদ্ভিদটিকে লুডভিগিয়া হিসপিফোলিয়া বলে ব্যাখ্যা করেন। 
জর্জ ডনের পূর্বে অবশ্য ড্যানিশ-নরওয়েজিয়ান উদ্ভিদবিদ, ভেষজবিদ ও প্রাণীবিদ মার্টিন হেনরিকসেন ভাল (Martin Henrichsen Vahl) ১৭৯৮ সালে সর্বপ্রথম উদ্ভিদটিকে শনাক্ত করেছিলেন। তাঁর দেয়া নাম ছিলো Fissendocarpa linifolia। এছাড়া সুইডিশ উদ্ভিদবিদ মার্ক মিশেলি (Marc Micheli), ব্রিটিশ উদ্ভিদবিদ হেনরি হ্যাজেলফুট হেইনেস (Henry Haselfoot Haines), ব্রিটিশ উদ্ভিদবিদ সিগমনি স্টিফেন রিচার্ড বেনেট (Sigamony Stephen Richard Bennet) এবং ভারতীয় উদ্ভিদবিদ রোলা সেশাগিরি রাও (Rolla Seshagiri Rao) এই উদ্ভিদটির ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়েছিলেন। এঁদের সবগুলো নামই সমনাম হিশেবে স্বীকৃত। তবে সেশাগিরি রাওয়ের প্রদত্ত নামটি এখনও অননুমোদিত অবস্থায় আছে।

Onagraceae (Juss.)

  1. Ludwigia L.

Ludwigia adscendens (L.) H.Hara

কেশরদাম


বৈজ্ঞানিক নাম : Ludwigia adscendens (L.) H.Hara 
সমনাম : Jussiaea adscendens L.; Jussiaea repens L. 
বাংলা নাম : কেশরদাম, ক্যাসলা, মালচা, মুলসি 
ইংরেজি নাম : Water Primrose, Water Dragon, Marshy Jasmine 
অন্যান্য নাম : পানি খুটোরা (আসাম); নীরুহাভু (কানাড়া); নীরুদন্তু (কানাড়া); কেসর (হিন্দি); নীর চরম্বু (মালয়ালাম); ইসিং কুন্দো (মণিপুরী); জাডেলো (নেপালি); নীরু বাছালি (তেলেগু); নীরু থিগালু (তেলেগু); লুডভিগিয়া গ্রান্ডেস (ফরাসি)
উদ্ভিদের দ্বিপদী নামের জনক কার্ল লিনিয়াস (Carl Linnaeus) ১৭৬৭ সালে তাঁর Mantissa Plantarum গ্রন্থে উদ্ভিদটিকে Jussiaea adscendens নামে শনাক্ত করেন। ফরাসি প্রকৃতিবিদ ও উদ্ভিদবিদ বার্নার্ড ডি জাসিইউ (Bernard de Jussieu)-এর প্রতি সম্মান জানিয়ে গণটির নাম জাসিইয়া করা হয়। 
বার্নার্ড জাসিইউ ১৬৯৯ সালের ১৭ আগস্ট পূর্ব ফ্রান্সের লিয়ন শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং দক্ষিণ ফ্রান্সের মন্টপিলার থেকে চিকিৎসাবিদ্যা পড়া শেষ করে ১৭২০ সালে চিকিৎসক পেশায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর ভাই অ্যান্টনি ডি জাসিইউ (Antoine de Jussieu) ছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত প্রকৃতিবিদ ও প্যারিস উদ্ভিদ উদ্যানের কর্মকর্তা। পেশা জমজমাট না হওয়ায় ভাইয়ের আমন্ত্রণে বার্নার্ড ১৭২২ সালে প্যারিসে যান এবং উদ্ভিদবিদ সেবাস্টিন ভ্যাইল্যান্টের (Sébastien Vaillant)-এর উত্তরসূরি হিশেবে প্যারিস উদ্ভিদ-উদ্যানের প্রদর্শক পদে যোগদান করেন। 
উদ্ভিদ-উদ্যানের চাকরিই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ফরাসি উদ্ভিদবিদ জোসেফ পিটন লিখিত (Joseph Pitton de Tournefort) প্যারিস অঞ্চলের উদ্ভিদের ইতিহাস (Histoire des plantes qui naissent aux environs de Paris) অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি উদ্ভিদ সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে ওঠেন এবং পরবর্তী কয়েক বছরে ফ্রেন্স অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সে উদ্ভিদ বিষয়ক একাধিক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন। উদ্ভিদের বিবর্তন বিষয়ে নিজ তত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য তিনি তিনবার নর্ম্যান্ডি উপকূলে অভিযান চালান। এছাড়া বড়ো ভাই অ্যান্টনিকে সঙ্গে নিয়ে স্পেন, পর্তুগাল ও দক্ষিণ ফ্রান্সে গবেষণা করেন। 
বার্নার্ড তাঁর আবিস্কারের স্বীকৃতির বিষয়টিকে মোটেই গুরুত্ব দিতেন না। তাই তাঁর তত্ত্বগুলোর প্রয়োগ দেখা যায় ভ্রাতুস্পুত্র অ্যান্টনি লরেন্ট ডি জাসিইউ (Antoine Laurent de Jussieu)-এর Genera plantarum বইতে। বার্নার্ড ডি জাসিইউ ১৭৭৭ সালে প্যারিসে মারা যান। তাঁর নামকরণকৃত উদ্ভিদের নামের শেষে B.Juss. যুক্ত করা হয়। 
কার্ল লিনিয়াসের নামকরণ অনুসরণ করে জাপানি উদ্ভিদবিদ হিরোশি হারা (Hiroshi Hara) ১৯৫৩ সালে তাঁর Ludwigia Versus Jussiaea গ্রন্থে Jussiaea গণের ২৯টি প্রজাতি Ludwigia গণের আওতাভূক্ত করেন। হিরোশি হারা ১৯১১ সালের ৫ জানুয়ারি জাপানের টোকিওতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানেরও দায়িত্ব পালন করেন। হিরোশি ১৯৮৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর টোকিওতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর শনাক্তকৃত উদ্ভিদের নামের শেষে H.Hara লেখা হয়।
পরিবর্তিত গণ লুডভিগিয়া নামটিও কার্ল লিনিয়াস কর্তৃক প্রদত্ত। 
লিনিয়াসের কাছ থেকে হিরোশি হারা প্রজাতির নাম adscendens গ্রহণ করেন। adscendens শব্দটির অর্থ শায়িত অবস্থা থেকে উপরের দিকে উত্থান। যে লতা, বীরুৎ বা গুল্ম প্রধানত ভূশায়ী অবস্থায় থাকে এবং অগ্রভাগ উপরের দিকে বেয়ে উঠতে চায় সেগুলোকে adscendens বলা হয়। জলের উপর কেশরদামের ডগা উর্ধ্বমূখী হয়ে থাকে বলে এমন নামকরণ করা হয়েছে।